আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় কাপড়ের সঠিক লে তৈরির শর্তাবলি। এই পাঠটি “বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড” এর টেক্সটাইল ডিপ্লোমা ডিসিপ্লিনের “গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারিং ২” বিষয়ের পাঠ।
কাপড়ের সঠিক লে তৈরির শর্তাবলি

কাপড় বিছিয়ে কাপড়ের সে সঠিক ও সুন্দরভাবে তৈরি করার জন্য বেশ কিছু শর্তাবলি পূরণ করা আবশ্যক। এ সকল শর্তাবলির মধ্যে কিছু অবশ্যই পূরণ করতে হবে, বাকিগুলো অত্যাবশ্যক নয়, তবে যদি পূরণ করা যায় তবে ভাল শর্তাবলিসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল, যার প্রথম তিনটি শর্ত পূরণ করা আবশ্যক। আর এ তিনটি শর্তকে মৌলিক শর্ত
১। কাপড়ের প্লাই অ্যালাইনমেন্টকরণ (মৌলিক শর্ত) : মার্কারের দৈর্ঘ্য ও গ্রন্থ অনুযায়ী কাপড় বিছানো হয়। কাপড় বিছিয়ে কাপড়ের সে তৈরি করার সময় কাপড়ের প্রতিটি প্লাই যেন মার্কারের দৈর্ঘ্য ও গ্রন্থের মধ্যে সঠিকভাবে ছাপিত হয়, তা অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
নতুবা যে প্লাই এর কাপড় মার্কারের দৈর্ঘ্য অথবা গ্রন্থের নির্ধারিত আয়তনের বাইরে বিছানো হবে, ঐ প্লাই এর কিছু প্যাটার্ন পিস ত্রুটিপূর্ণ কাটা হবে এ ঘটনা যাতে না হয়। এজন্য প্রতিটি প্লাই কাপড়ের এই বরাবর অন্ততপক্ষে একদিকের পাড় (Selvedge) একই লক্ষে স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। আবার কখনো কখনো কাপড়ের প্রস্থ বরাবর এটির মধ্যবর্তী স্থান (Center position) একই লম্বে স্থাপন ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। মার্কারের দৈর্ঘ্য বরাবর একিটি প্লাই এর দৈর্ঘ্য সঠিক মতো বিছানো নিশ্চিত করার জন্য মার্কারের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা কাপড়ের সে এর দৈর্ঘ্য প্রতি মাধায় ২ সে.মি বেশি নেয়া হয়।

২। সঠিক প্লাই টেনশন (Correct ply tension) (মৌলিক শর্ত) : কাপড়ের প্লাইকে একটির উপর অপরটি সুন্দরভাবে স্থাপন করে কাপড়ের লে তৈরি করা হয়। কাপড় হাতেও বিছানো যায় আবার মেশিনের সাহায্যেও বিছানো যায়।
যে পদ্ধতিতেই কাপড় বিছানো হোক না কেন তা অবশ্যই টেনশনবিহীনভাবে বিছাতে হবে এবং প্রতিটি প্রাই কাপড়ের মধ্যে একই রকম টেনশনবিহীন অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কাপড় বিছানোর সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। যেন কাপড় বেশি ঢিলা অবস্থায় বিছানো না হয়, কারণ তাহলে কাপড়ের লে ত্রুটিপূর্ণ হবে, কাপড় কাটা অসুবিধাজনক হবে ও প্যাটার্নসমূহও ত্রুটিপূর্ণ হবে।
কাপড় বিছানোর সময় যদি টেনশন বেশি রেখে কাপড় বিছানো হয় তবে কাপড় কাটার পরে অথবা কাপড় সেলাই) করার পরে পোশাকের বিভিন্ন অংশ সংকুচিত হতে পারে, যার ফলে পোশাক ত্রুটিপূর্ণ হবে। এজন্য কাপড় বিছানোর সময় কাপড়ের টেনশন খুবই সতর্কতার সাথে ও সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
কিছু কিছু কাপড় আছে, যার মধ্যে অন্তর্নিহিত টেনশন বিদ্যমান থাকে, যা কাপড় তৈরি করার সময় অথবা রোল করারসময় অর্জিত হতে পারে। এ সকল কাপড় লে তৈরি করার পূর্বেই টেনশনযুক্ত করে নিতে হবে। কোন কোন কাপড় আছে যেমন নিটেড কাপড় অথবা যে সকল কাপড়ে ইলাস্টিক সুতা বা টেক্সাবড় সুতা আছে ঐ সকল কাপড় খুব সহজেই লম্বা হয়ে যায়। ঐ সকল কাপড় বিছানোর সময়ও বিশেষ সতর্কতা নেয়া হয় এবং তদুপরি কাপড়ের লে তৈরি করার পর ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টা পরে কাপড় কাটা হয়, যাতে উক্ত সময়ের মধ্যে কাপড় তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারে।
কাপড় বিছানোর সময় কাপড়ের এ টেনশন সমস্যা দূর করার জন্য আধুনিক স্প্রেডিং মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে এবং যদি ঐ মেশিন ব্যবহার করা হয় তবে আরও বেশ কিছু আনুষঙ্গিক সুবিধা পাওয়া যায়।
৩। প্রতিটি প্লাই সমতল হতে হবে (Fabric must be flat ) ( মৌলিক শর্ত): কাপড় বিছানোর সময় অবশ্যই লক্ষ রাখতে হবে যেন কাপড়ের মধ্যে কোথাও কোন ভাঁজ না থাকে বা কাপড় কোথাও যেন কুঁচকে না থাকে। যদি এটা পাওয়া যায় তবে তাৎক্ষণিক দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কাপড় বিছানোর সময় যদি সমতলে বিছানো না হয় অর্থাৎ উল্লিখিত ত্রুটি বিদ্যমান থাকে তবে ঐ অংশের প্যাটার্ন ত্রুটিপূর্ণ হবে। যার ফলে উক্ত প্যাটার্ন দ্বারা তৈরি পোশাকও ত্রুটিপূর্ণ হবে।
৪। কাপড়ের ত্রুটি দূরকরণ (Elimination of fabric flaws) :কাপড় বিছানোর সময় কাপড়ে যদি কোন প্রকার। ত্রুটি থাকে তবে তা চিহ্নিত করতে হবে এবং উক্ত ত্রুটি দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। ত্রুটি চিহ্নিত করা বা ত্রুটি মুক্ত করার দায়িত্ব যে কাপড় বিছানোর দায়িত্বে থাকবে তাকে নিতে হবে।
কাপড় বিছানোর সময় বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি দেখা দিতে পারে, যেমন— ত্রুটিযুক্ত স্থানের কাপড়টুকু কেটে বাদ দিয়ে প্লাইস (Splice) এর মাধ্যমে পুনরায় কাপড় বিছানো যেতে পারে। মার্কারের মধ্যে স্প্রাইস চিহ্ন যদি পূর্বেই করা থাকে তবে তা অনুসরণ করতে হবে নতুবা পর্যাপ্ত ওভারল্যাপিং এর ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে উক্ত স্থানের সকল প্যাটার্নসমূহ পূর্ণ আয়তনের পাওয়া যায়।
অপেক্ষাকৃত কমদামি পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে কখনো কখনো কাপড়ের ত্রুটি কাপড় বিছানোর সময় রেখে দেয়া হয় এবং পোশাক তৈরির শেষে ত্রুটিযুক্ত পোশাকটি নিরীক্ষা করার সময় বাদ দিয়ে দেয়া হয়। আবার কখনো কখনো কাপড় বিছানোর সময় কাপড়ের ত্রুটি যদি ছোট স্থানে জুড়ে হয় তবে ঐ স্থান মেটাল টেপ লাগিয়ে দেয়া হয়।
অতঃপর কাটা শেষ হওয়ার পর কাপড়ের প্যাটার্ন এর বান্ডেল একটি মেটাল ডিটেক্টর মেশিনের ভেতর দিয়ে অতিক্রম করানো হয়। যে বান্ডেলে মেটাল টেপ থাকে ঐ বান্ডেলটি উক্ত মেশিন দ্বারা চিহ্নিত হয়। চিহ্নিত বান্ডেল হতে ত্রুটিযুক্ত প্যাটার্নটি আলাদা করে নেয়া হয় ও আর একটি ঐরূপ প্যাটার্ন কেটে ঐ বান্ডেলে পুনঃস্থাপন করা হয়।
৫। কাপড়ের প্লাই-এর সঠিক দিক নির্ধারণ (Correct ply direction) : কাপড় বিছানোর পূর্বেই দেখে নিতে হবে যে কাপড় কী ধরনের। কাপড় যদি সিমেট্রিক হয় অর্থাৎ (উভয় দিক একই রকম) তবে কোন সমস্যা হবে না। কিন্তু কাপড় যদি এসিমেট্রিক হয় অর্থাৎ (উভয় দিক একই রকম নয়) তবে কাপড়ের প্লাই এর দিক মার্কারের পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে সতর্কতার সাথে নির্ধারণ করতে হবে, নতুবা পোশাক ত্রুটিযুক্ত হবে।
৬। স্থির বিদ্যুৎ দূরকরণ (Elimination of static electricity):কাপড় বিছিয়ে লে তৈরি করার সময় ঘর্ষণের কারণে কাপড় এর মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে পানো। বিশেষ করে যে সকল কাপড়ের মধ্যে সিনথেটিক তন্তুর পরিমাণ অধিক সেই সকল কাপড় বিছানোর সময় কাপড়ের মধ্যে স্থির বিদ্যুৎ বেশি উৎপন্ন হয়।
ফলে কাপড়ের একটা প্লাই এর উপর আর একটা চাই স্থাপন করতে বেশ অসুবিধার সৃষ্টি হয় অর্থাৎ আকর্ষণ বা বিকর্ষণঞ্জনিত কারণে কাপড়ের প্রাইসমূহ সঠিকভাবে বিছানো ও প্রতিস্থাপন করা যায় না। এ অসুবিধা দূর করার জন্য কাপড়ে যাতে কম ঘর্ষণ হয় তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে অথবা কক্ষে, বাতাসের আর্দ্রতা বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে অথবা কাপড়ের গে এর সাথে আর্থিং এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৭। সহজে কাপড়ের লে বা বান্ডেল পৃথকীকরণ (Easy seperation of the cut lay into bundles) : কাঁটা কাপড়ের বান্ডেলের আকৃতি নির্ভর করে কাপড়ের লে এর উচ্চতার উপর। কাপড় বিছানোর সময় কাপড়ে রং অথবা শেডের পার্থক্যজনিত কারণে অথবা অন্য কোন কারণে প্লাইসমূহের মধ্যে পৃথকীকরণ চিহ্ন ব্যবহার করা দরকার হতে পারে।
এই পৃথকীকরণের জন্য কমমূল্যের রঙিন কাগজের স্তর কাপড়ের প্লাই এর মধ্যে ব্যবহার করা হয়। কাপড় কাটার পরে প্রতিটি বান্ডেলের মধ্যে রং বা রঙের পার্থক্যজনিত কারণে পৃথক করার জন্য উক্ত রঙিন কাগজের ব্যবহার অত্যন্ত সহায়ক হয়। এ কাজের জন্য ব্যবহৃত রঙিন কাগজ সাধারণত খসখসে (Rough surface) পৃষ্ঠবিশিষ্ট হয়ে থাকে।
৮। কাপড়ের লে কাটার সময় কাপড়ের গলন নিয়ন্ত্রণ (Avoidence of fusion of plles during cutting) : কাপড়ের লে, কাটিং নাইফ দ্বারা কাটার সময়, কাপড় ও নাইফ এর মধ্যে যে বর্ষণ হয় তার ফলে তাপের সৃষ্টি হয়। যে সকল কাপড়ের মধ্যে গার্মোপ্লাস্টিক আঁশ থাকে ঐ সকল আঁশ ঘর্ষণজনিত তাপের ফলে গলে যায়। ফলে গলিত পদার্থসমূহ একত্রে জোড়া লাগার কারণে পলিমার বিড (Polymer bid) বা দানা আকার ধারণ করে অথবা কাটা প্রান্ত একটির সাথে অপরটি জোড়া লেগে যায়।

ফলে প্যাটার্নসমূহ পৃথক করা অত্যন্ত অসুবিধাজনক হয় ও ত্রুটিপূর্ণ প্যাটার্নের সৃষ্টি করে।এ ধরনের সমস্যা যাতে না হয় এজন্য কাপড়ের লে তৈরি করার সময় কাপড়ের প্লাই এর ফাকে কারে অ্যান্টিফিউশন,(Antifusion) কাপড়ের প্লাই বিছানো হয়। অ্যান্টিফিউশন কাগজের মধ্যে পিচ্ছিল পদার্থ থাকে, যা কাপড় কাটার সময়কাটিং নাইককে লুব্রিকেট করে। ফলে কাপড় ও নাইফ এর মধ্যে ঘর্ষণ ও ঘর্ষণজনিত তাপ কম হয়। তাপ কম হওয়ারকারণে কাপড় ফিউজ হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যায়।
৯। কাপড়ের লে যেন বিকৃত না হয় (Avoidance of distortion in spread) :কাপড়ের লে স্থানান্তর করার সময় অথবা কাপড়ের লে স্ট্রেইট নাইক দিয়ে কাটার সময়, লে এর নিচের দিকে নাইফের বেস প্লেট এর সাথে ঘর্ষণের কারণে কাপড়ের প্লাই কুঁচকে অথবা ভাঁজ পড়ে যেতে পারে। ফলে কাপড় কাটার পর ত্রুটিপূর্ণ প্যাটার্ন তৈরি হতে পারে।
এ ধরনের অসুবিধা পরিহার করার জন্য কাপড়ের পে-সমূহ কাগজের উপর তৈরি করা হয়। উপরন্তু মসৃণ কাপড় ব্যবহারের ফলে কাপড়ের সাথে টেবিলের ঘর্ষণের ফলে কাপড়ের পৃষ্ঠ অমসৃণ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না ।
১০। কাপড়ের চেক ও স্ট্রাইপ ম্যাচিং (Matching checks and strips): কাপড় বিছিয়ে কাপড়ের লে তৈরির সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন একটি প্লাই এর উপর অপরটি বিছানোর সময় কাপড়ে যদি স্ট্রাইপ চেক থাকে তবে তা মিলিয়ে বসাতে হবে। পোশাকের মধ্যে স্ট্রাইপ বা চেক মিলানোর স্বার্থে মার্কার প্ল্যানিং করার সময়ও তা মিলিয়ে বসাতে হবে। এ ম্যাচিং কাপড়ের টানার দিকে অথবা পড়েনের দিকে অথবা উভয় দিকে করা প্রয়োজন হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ